You are currently viewing বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন

  • Post comments:0 Comments
  • Reading time:1 mins read

ডাঃ হেলাল উদ্দিন আহমেদঃ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেন প্রায় ৩০০০ জন । আর প্রতিদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করে এর প্রায় বিশ গুন বেশি মানুষ। গবেষনা মতে প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনাকে প্রতিরােধ করা না গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটিকে অবশ্যই প্রতিরােধ করা যায়- তাই বলা হয় আত্মহত্যা প্রতিরােধযােগ্য। বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে যাবার পর বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে সচেতনতামূলক উদ্যোগ অনেক বেড়েছে। কিন্তু সঠিক ও কার্যকরী প্রতিরােধনীতি বা ইফেক্টিভ প্রিভেনশন পলিসি করার জন্য সবার আগে প্রয়ােজন জাতীয় পর্যায়ের একটি গবেষনা যার মাধ্যমে তৈরি হবে কার্যকরী নীতিমালা। বেশ কয়েকটি ছােট ও মাঝারী পর্যায়ের গবেষনার ফলাফলে দেখা গেছে এদেশে প্রতি বছর- প্রতি লাখে ৭.৮ জন মানুষ আত্মহত্যা ঘটিয়ে থাকে। (বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ রাষ্ট্র গায়ানা এ হার প্রতিবছর প্রতি লাখে ৪৪ জন।)

আত্মহত্যা প্রতিরােধ করার সামাজিক আন্দোলনে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে সবচাইতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে প্রচার মাধ্যমগুলাে। ২০০৮ সালে হংকং এর মিডিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফু কে ডাব্লিও তার এক গবেষনাপত্রে উপস্থাপন করেন যে হংকং এর চাইনিজ ও ইংরেজী ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্রগুলােতে আত্মহত্যার সংবাদগুলাে প্রকাশ না করা বা প্রকাশ করলেও অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করায় সেদেশে আত্মহত্যার হার ও প্রবণতা কার্যকরীভাবে কমে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রচার মাধ্যমগুলাের জন্য আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনার একটা সাধারণ গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের দেশে কোনাে কোনাে আত্মহত্যার ঘটনাকে সহমর্মীতা দেখাতে যেয়ে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তি বা বিষয়কে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপিত করে, আত্মহত্যাকারীকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নায়কোচিত ভূমিকায় রূপান্তর করা হয় । এর ফল হয় ভয়াবহ। আত্মহত্যা করলে মৃত আমি অনেক সহমর্মীতা পাবাে যা অনেকটা সামাজিক ন্যায়বিচারের বিকল্প হবে, এই বােধে ঘটতে পারে আরাে নতুন আত্মহত্যা। বাংলাদেশে কিছু সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনাকে সঠিকভাবে প্রকাশ ও প্রচার করায় আমরা দেখি সেটি প্রকাশের পরপরই আরাে কয়েকটি লাগাতার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহত্যা’ এ ধরণের শিরােনাম পরের বছরের পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রটিকে উপায় বাতলে দেয় পরীক্ষায় ফেল করলে কী করতে হবে।

অবশ্য কেবল সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা পরিবর্তন করে নয়- পাঠক ও দর্শক রুচিরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আত্মহত্যার খবরগুলাে পাঠক পড়তে চায়-দেখতে চায় বলেই বােধহয় প্রচার মাধ্যম গুলাে সেগুলাে পাঠকদের পড়ায়- দেখায়। পাঠকের বা দর্শকের এদিক থেকে পরিবর্তিত হতে হবে, সকলের স্বার্থে। খেয়াল রাখতে হবে যে একটি আত্মহত্যার ঘটনাকে ‘নিউজ’ থেকে “স্টোরিতে রূপান্তরিত করতে যেয়ে আরাে নতুন করে আত্মহত্যার তালিকা যেন বেড়ে না যায়। আশার কথা এই যে আমাদের দেশের বেশ কিছু পত্রিকা ও নিউজ চ্যানেল বিষয়টি সম্পর্কে খুবই সচেতন এবং যথেষ্ট সংবেদনশীলতার সাথে আত্মহত্যার খবর পরিবেশন করে। কিন্তু তারপরও বিষয়টি নিয়ে সকল সংবাদকর্মীদের একটি সাধারণ নীতিমালা মেনে চলা উচিৎ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইন্টারন্যাশনাল এসােসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন যৌথভাবে আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশন বিষয়ে সংবাদকর্মীদের জন্য একটি গাইডলাইন প্রণয়ণ করেছেন। আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তাে আমরা সেটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারবাে না কিন্তু আমাদের নিজেদের মত করে সেটাকে যতটুকু পারি মেনে চললে প্রতিরোধ করা যাবে অনেক আত্মহত্যার ঘটনা। সেই গাইডলাইন অনুযায়ী প্রথমেই আত্মহত্যা বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার মাধ্যমগুলােকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার কথা কলা হয়েছে।

আত্মহত্যার সংবাদটি প্রথম পৃষ্ঠায় বা অন্যত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রকাশ করা যাবে না। সংবাদটির শিরােনামে এমন কোনাে শব্দ বা বাক্যৱীতি ব্যবহার করা উচিৎনয়া যা পাঠক বা দর্শককে উদ্দীপনার খােরাক দেয় আবার এমন কাবে প্রকাশ করা যাবেনা যে আত্মহত্যা একটি মামলী স্বাভাবিক মৃত্যুমাত্র, অর্থাৎ, অত্যন্ত সতর্কতা সাথে শব্দ বাছাই করতে হবে।

যেমন – অপমান সইতে না পেরে রেল লাইনে মাথা পেতে দিলাে অমুক না ‘অভিমান করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অমুক ইতালি আলংকারিক বাক্যরীলির চাইতে লেল সংক্ষিপ্ত শিরােনাম দেয়া উচিৎ ‘অমুকের আত্মহত্যা’। শিরােনামে যেন এমন কোনাে বার্তা না থাকে যাতে মনে হয় আত্মহত্যা কোনাে সমস্যার সমাধান। ঋণ থেকে চির মুক্তি পেল অমুক বা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তরুণের বিষপান’ ইত্যাদি শিরােনাম যেন না হয়। আত্মহত্যার খবরটিকে নিয়ে পরপর ফলােআপ স্টোরি করার কোনাে প্রয়োজন নেই। কিভাবে একসুন আত্বহত্যা করেছে বা করবার চেষ্টা করে কেন ব্যর্থ হয়েছে সে বিষয়গুলাে যেন বিস্তারিত বিবরণ আহহত্যার সংবাদে না থাকে। এ ধরণের বিবরণ ভবিষ্যতে আরাে একজনকে একটি সফল আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে। পাশাপাশি আত্মহত্যার স্থান নিয়ে যেন কোনাে সংবাদ না থাকে যেমন কোনাে বিশেষ উচু স্থান বিশেষ পুকুর ইত্যাদিতে প্রায়ই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বলে প্রচার মাধ্যমে সাধারণের জন্য সংবাদ পরিবেশন করা যাবেনা- জুবে স্থানটিকে নিরাপদ রাখতে প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষকে আলাদা করে জানানাে যেতে পারে। আত্মহত্যাকারীর ছবি প্রকাশ না করাই শ্রেয়।

আর আত্মহত্যার পরে মৃতদেহের ছবি বা ভিডিও ফুটেজ কোনোভাবেই প্রকাশ করা উচিৎ নয়। সেলিব্রেটি বা বিখ্যাত বা জনপ্রিয় কেউ আত্মহত্যা করে ফেললে বিষয়টিকে দ্বিগুন সৰ্কতার সাথে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। অাত্মহত্যাকারীর পরিবারের নিকটজনদের শােকের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে- এমন কোনাে শব্দ বা তথ্য দেয়া যাবেনা যাতে নিকটজনদের শোক আরাে ঘণীভুত হয় এবং তাদের মধ্যেও আবার আত্মহত্যার ইচ্ছা জেগে উঠে। পাশাপাশি আত্মহত্যার প্রতিটি সংবাদের সাথে এমন কিছু তথ্য সরবরাহ করতে হবে যেখানে উল্লেখ থাকবে যে মাতৃহত্যার চিন্তা বা ইচ্ছা করলে একজুন মানুষ কোথায়। সাহায্য পেতে পারে। প্রথাগত প্রচার মাধ্যমের পাশাপাশি বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযােগের সাইটগুলাের ব্যবহারকারীদের সতর্কতার সাথে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পােস্ট ক্লাতে হবে। এখানেও কোনাে আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানাের চেষ্টা করা যাবেনা। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যােগাযােগের সাইটহুলাের কর্তৃপক্ষেও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়ােজন। চলচ্চিত্রকার, নাট্যনির্মাতা এমনকী গল্প উপন্যাস যারা লিখেন তাকেও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে- ইতিবাচক ভাবে, আত্মহত্যা প্রতিরোধে তাঁদের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের যাপিত জীবনের সবটাই সাফল্যে এরা নয়- আছে ব্যর্থতা, আছে হতাশা। কিন্তু সব কিছুর পরও জীবনই পরম সত্য। এই সত্যকে ধারণ করে আত্মহত্যা প্রতিরােধে সকলকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরােধ নীতিমালা তৈরি করতে হবে আমাদেরকেই, আমাদের মত করে, আমাদের জন্য।

Leave a Reply