যুগের অস্থিরতা ও আত্মহত্যার অভিশাপ

  • Post comments:0 Comments
  • Reading time:1 mins read

  -বিটিএফ পর্যবেক্ষণ

                                                             ”আপনি যে দুঃখ ডেকে আনি

সে-যে জ্বালায় বজ্রানলে।।

অঙ্গার করে রেখে যায়,

সেথা কোন ফল নাহি ফলে।”

                                          -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুমহান স্রষ্টা যেসব অমূল্য উপহার আমাদের জন্যে প্রতিনিয়ত প্রেরণ করে যাচ্ছেন, সেসবের যথাযথ মূল্যায়ণ না করে আমরা আজ বেছে নিয়েছি ভয়াবহ অপ্রাকৃতিক জীবন-যাপন পন্থা। মায়েরা আজকাল আর রান্না করা খাবার তাদের স্কুলগামী পুত্র-কন্যার টিফিন-বক্সে পুরে দেওয়ার ঝামেলা কাঁধে নিতে চাইছেন না। দুখানা হাতে গড়া রুটি আর খানিকটা সবজি বাচ্চার টিফিন-বক্সে পুরে দিলে চাকচিক্যময় ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে বাচ্চা তো ক্লাউন হিসেবে চিহ্নিত হবে! ঐ বাচ্চা যে ধনাধ্য ববসায়ী বা উচ্চ-পদস্থ সরকারী চাকুরের বাচ্চা, বারবার কেক-চিপস-কোকের ঢাক-ঢোল বাজিয়ে এটা প্রচার না করলে বাচ্চার অভিবাবকের মাথায় অদৃশ্য-শিরোপায় খোদিত ‘এলিট’ তকমাটা যে ধুয়ে-মুছে যাবে! পাগড়ি বাঁচাতে তাই মাথা-বলি দিতেই হবে। হোক না বাচ্চার পেট লাগাতার মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট ও আরো গুটিকয় কৃত্রিম প্রিজারভেটিভের গুদাম-ঘর। স্নায়ুবিক সুস্থতা, নিয়ন্ত্রিত খ্যাদ্যাভ্যাস এসব মান্ধাতা-আমলের শব্দবন্ধগুলো অভিধান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিকে-দিকে ডিজিটাল এলিটনেসের জয়ধ্বজা ওড়াতে না পারলে তো জীবনের কোনো অর্থই থাকেনা(!?)।

সুপ্রিয় পাঠক, পড়ে হাসি পেলেও উল্লিখিত বাক্যমালায় যুগের অস্থিরতার চিত্র অংশত প্রতিবিম্বিত। একথার সমর্থনে একটু অতীত-অন্বেষণে লিপ্ত হতে হয়। বাংলা সাহিত্যের গৌরব, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে এই অন্বেষণ। বিশ্বকবি তাঁর শৈশব-কৈশোরে কেমন জাঁদরেল অভিভাবকের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ গ্রাহ্য করেছেন, সেই বার্তা তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে অসংখ্য রবীন্দ্রান্বেষী পাঠকের দপ্তরে পৌছে দিয়েছেন। আমরা জানতে পারি যে ঠাকুর-বাড়ির ভৃত্যের কারচুপি করার কোনো সুযোগ ছিল না। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের (রবীন্দ্রনাথের পিতা) কঠোর নির্দেশ অমান্য করে হাড় কাঁপানো শীতের সকালেও বালক রবীন্দ্রনাথের স্নানের জল লুকিয়ে-চুরিয়ে গরম করার সাহস হতোনা তার। বরফ-গলা ঠাণ্ডা জলেই বালক রবিঠাকুর শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় তাঁর প্রত্যুষ-উপাচার সম্পন্ন করতেন প্রতিদিন। ঠাণ্ডা জলে স্নান করার অভ্যেস গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ‍চিকিৎসা-বিজ্ঞানও স্বীকার করে। আজকাল একাধিক সচেতন চিকিৎসক অম্বল আর উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের গরম জলে স্নান না করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সে যাই হোক, স্নানঘরে গিজার না লাগালে আমাদের সন্তানদের আমরা অতিমাত্রায় কোল্ড-সেনেসিটিভ কীভাবে করে তুলবো!? ‘’ও কোটিপতির সন্তান। এক ফোটা ঠাণ্ডা জল গায়ে পড়লেই ওর হাঁচি শুরু হয়ে যায়।” এজাতীয় সম্মান-সূচক মন্তব্য না শুনলে কীভাবে চলবে আমাদের!?

খ্যাদ্যাভ্যাস আর স্নানাভ্যাসের বারোটা বাজিয়ে আমাদের সন্তানদের আমরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছি তা নিয়ে অল্প-সল্প বলা হলো। এবারে আর কোন কোন অর্থহীন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পরোক্ষে আমরা আমাদের সন্তানদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যাচ্ছি তা নিয়ে একটু বলবো। আধুনিক কর্মজীবী মায়েরা স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরির পেছনে বাসার রান্নাঘরে সময় দিতে পারেন না। কিন্তু, অফিস থেকেই বাসায় ফিরেই অনলাইন সার্চিং করে বহুমূল্য পোশাক ও গহনার জন্যে অনলাইন-অর্ডার দিতে তারা কখনোই আলস্য বোধ করেন না। আর, অনলাইন সার্চিং করতে করতে এসব মায়েরা ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করেন। আমাদের স্কুল-কলেজগামী ছেলে-মেয়েরা জনক-জননীর কর্মকাণ্ড গভীর অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করে থাকে। এ যুগের পিতারাও সন্তানদের সময় দিতে পারেন না। এত সময় তারা পাবেনই বা কোথায়! চাকরি/ব্যবসা করার পর যেটুকু সময় তাদের হাতে থাকে, সেটুকু তারা ক্লাবে-পার্টিতে বিনোদন যজ্ঞে ব্যয় করে আসেন। সাধক-সাহিত্যশিল্পী লিও টলস্টয় কাষ্ঠকুঠির থেকে শ্বেত মহলে পৌছে যাওয়া বর্ণময় ব্যক্তিত্ব আব্রাহাম লিংকনের জীবন-ইতিহাস এ যুগের সন্তানরা তাদের মা বাবাদের মুখ থেকে শুনতে পায় না। তাছাড়া, এটাও তারা বুঝে গেছে যে দামী জামা-জুতো পরে ক্লাবে-পার্টিতে আড্ডা দেওয়া আর অনলাইন চ্যাটিংয়ে নিমজ্জিত হওয়াই জীবনের অন্য নাম। সব মিলিয়ে আমরা যে উপসংহার টানতে পারি সেটা হচ্ছে- জাঁকজমকপূর্ণ উদ্যোগ-আয়োজনের মাধ্যমে আমরা আমোদের সন্তানদের স্নায়ুবিক ও মানসিক অসুস্থতা নির্মাণ করে যাচ্ছি। আর, আত্মহত্যা-প্রবণতার জন্য স্নায়ুবিক ও মানসিক অসুস্থতাই দায়ী। আমাদের ছেলে-মেয়েরা আত্মহননের পথ বেছে নিলে আমরা অবিরল নয়নাশ্রু ঝরাতে থাকি। কিন্তু, ভূত যে সর্ষের ভেতরেই রয়েছে, সেটা আমাদের মাথায় ঢুকছে না। তামাকের চাষ করে আমরা তামাকের খেতে স্ট্রেবেরি কেন ফলছেনা এমন দুর্ভাবনা মস্তিষ্কে লাগাতার বহন করে যাচ্ছি। আসলে জীবনান্দ-চিহ্নিত ’অদ্ভুত আঁধার’- এ আজ ছেয়ে গেছে পৃথিবী।

Leave a Reply